আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মানুষ 1971: From Australia with Love

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মানুষ 1971: From Australia with Love

অস্ট্রেলিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার আপামর জনসাধারন একাত্তরে আমাদের মুক্তিসংগ্রামে আমাদের প্রতি বাড়িয়ে দিয়েছিল তাদের বন্ধুত্বের হাত। দুনিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের মত অস্ট্রেলিয়াও সেই যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছিল, বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছিল, এবং উদ্বাস্তুদের জন্য মানবিক সাহায্যের ডালি নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। অস্ট্রেলিয়ার সেই ভূমিকার কথা আজকে আমরা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করি।

পশ্চিমা দেশগুলির মধ্যে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডই বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয়, ২৬শে জানুয়ারী ১৯৭২ সালে। তার আগে, স্বাধীনতা ঘোষনার প্রাক্কালে, ২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় এবিসি’র আন্তর্জাতিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস ‘রেডিও অস্ট্রেলিয়া’ ছিল প্রথম বিদেশী মিডিয়া যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা প্রচারিত হয় এবং তার ফলে সারা বিশ্ব সেটা জানতে পারে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ডাচ-অস্ট্রেলিয়ান উইলিয়াম এ এস আউডারল্যান্ড যে একমাত্র বিদেশী হিসেবে বীর প্রতিক খেতাব পেয়েছেন, সে কথা বোধ করি আমরা সকলেই জানি। আরো একটু মনে করিয়ে দিতে চাই যে, এই আউডারল্যান্ড কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন সক্রিয় কমান্ডো অফিসার ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি বাটা শু কোম্পানীর সিইও হিসেবে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। ২৫শে মার্চের ‘অপারেশান সার্চলাইট’ এর পরে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পাকিস্তানীদের বর্বরতার বেশ কিছু ছবি তুলে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় পাঠান এবং বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে সাহায্য করেন। এর পরে মুক্তিবাহিনী গঠিত হলে তারা প্রাথমিকভাবে গেরিলা যুদ্ধের কৌশল বেছে নেয়, এবং তখন আউডারল্যান্ড তার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ঢাকায় বেশ কয়েকটি গেরিলা অপারেশান পরিকল্পনায় ভূমিকা রাখেন। টঙ্গীস্থ বাটা কোম্পানীর ফ্যাক্টরী এবং অফিসে তিনি গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দেন, এবং ঢাকা ও তার আশেপাশের এলাকায় বেশ কয়েকটি অপারেশান পরিচালনা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তিনি খাবার, পানীয়, ঔষধ ও আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করেন।

আউডারল্যান্ড সবচেয়ে বড় যে কাজটি করেছেন আমাদের দেশের জন্য, তা হল গুপ্তচর বা গোয়েন্দা হিশেবে কাজ করে পাকিস্তানি বাহিনীর নানান তথ্য মুক্তিবাহিনীকে জোগাড় করে দেওয়া। এই কাজে তার দক্ষতা, চাতুর্য ও সাহসিকতা সত্যিই প্রশংসনীয়। পাকিস্তান বাহিনীর ২২তম বালুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন সুলতান নেওয়াজের সঙ্গে তিনি কৌশলে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং এভাবে ঢাকা সেনানিবাসে প্রবেশাধিকার লাভ করেন। পরে তিনি গভর্ণর জেনারেল টিক্কা খান এবং মেজর রাও ফরমান আলীর সঙ্গেও যোগাযোগ গরে তোলেন। তিনি বিদেশী হওয়াতে তার পক্ষে সেটা সম্ভব হয়েছিল। তিনি জেনারেল নিয়াজীর ‘বিশেষ বন্ধু’ হিশেবে পাক-বাহিনীর সদর দফতরে অবাধ যাতায়াতের অনুমতি পান। সেক্টর দুই এর মেজর এটিএম হায়দারের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ হত এবং তিনি পাকিস্তান বাহিনীর নানা গোপন তথ্য মেজর হায়দারকে সরবরাহ করতে থাকেন।

১৯৯৮ সালে ততকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে আমন্ত্রণ জানান পুরষ্কার ও সনদপত্র গ্রহনের জন্য, কিন্তু অসুস্থতার জন্য তিনি যেতে পারেননি। ২০০১ সালের ১৮ই মে পার্থের একটি হাসপাতালে বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধু পরলোকগমন করেন। আসুন আমরা তাঁর বিদেহী আত্নার শান্তি কামনা করি।
———-

২০১৩ সালের ২৪শে মার্চ তারিখে বাংলাদেশ সরকার ৪৪ জন ভারতীয় সহ মোট ৬৮ জন বিদেশী নাগরিককে “ফ্রেন্ডস অফ লিবারেশান ওয়ার” সন্মাননা প্রদান করে। সেই তালিকায় একজন অস্ট্রেলিয়ানও ছিলেন, যার নাম হার্ব ফিথ। হার্ব ফিথ মোনাশ ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অফ আর্টসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক ছিলেন, এবং বর্তমানে মোনাশে তার নামে একটি ফাউন্ডেশন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে হার্ব ফিথের এই মরনোত্তর সন্মাননা গ্রহন করেন তার ছেলে ডেভিড ফিথ, যা ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য বাঙালি জাতির তরফ থেকে সন্মান ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শনরূপে’ প্রদান করা হয়। ডেভিড ফিথ তার এই ঢাকা সফরকে নিয়ে একটি দীর্ঘ রিপোর্ট লিখেছেন, যা মোনাশ ইউনিভার্সিটির হার্ব ফিথ ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে। এই রিপোর্টে ডেভিড মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে তার বাবার যাবতীয় কর্মকান্ড তুলে ধরেছেন, যা অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশী হিশেবে আমাদের জন্য গর্বের ইতিহাস।

ডেভিড ফিথ লিখছেন, পঁচিশে মার্চের পর পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) মানবিক বিপর্যয়ের খবর যখন মিডিয়া-মারফত মেলবোর্নে পৌঁছায়, তখন তার বাবা হার্ব ফিথ সহ বেশ কিছু মানুষ তা নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়ে। পাকিস্তান বাহিনীর ভয়ানক নৃশংশতা তাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। পুরো ১৯৭১ সাল জুড়েই ফিথ ও তার বন্ধুরা বাংলাদেশে চলা রাষ্ট্র বনাম জনগণ অসম যুদ্ধ এবং উদ্বাস্তু সমস্যার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তারা ‘ভিক্টোরিয়ান কমিটি টু সাপোর্ট বাংলা দেশ’ গঠন করেন, যার আহবায়ক ছিলেন হার্ব ফিথ, সঙ্গে ছিলেন মার্ক র‍্যাপার, চার্লস চোপেল, জন ডানহাম, ডেভিড স্কট এবং আরো অনেকে। এই কমিটির উদ্দেশ্য ছিল এরকমঃ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা, অথবা বাংলাদেশের বেশীরভাগ মানুষের আকাঙ্খার ভিত্তিতে এমন একটা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা যেখানে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভেতরেই এই জনগোষ্ঠীর নিজেদের যথেষ্ঠ স্বায়ত্বশাসন থাকবে, যাতে বাংলাদেশের মানুষ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নানা ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে এবং যে উদ্বাস্তুরা পার্শ্ববর্তী দেশে আছে, তাদেরকে বাংলাদেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে পারে। মূল কোটেশানটি এরকম –
‘working for the establishment of either an independent Bangla Desh State, or (depending on what is desired by the majority of the Bangla Desh people) an arrangement whereby sufficient meaningful autonomy is provided within the Pakistan state to make it possible for Bangla Desh nationalists to play an active part in public life and for the refugees to return home’ (Victorian Committee to Support Bangla Desh paper, 1971).

এই কমিটির সদস্যরা বাংলাদেশের চলমান সংকট সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য লিফলেট ও পোষ্টারের মাধ্যমে প্রচার করেন, এই বিষয়ে সেমিনার আয়োজন করেন, ত্রাণের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেন, এমনকি অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্টের সদস্যদেরকে বাংলাদেশে জরুরীভিত্তিতে ত্রানসামগ্রী পাঠাতে এবং সেদেশের সংকট নিরসনে মধ্যস্থতা করতে চাপ প্রদান করেন।

সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। ফ্লিন্ডার্স ইউনিভার্সিটিতে বার্ষিক এশিয়ান লেকচার সিরিজে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা বক্তব্য দেন হার্ব ফিথ। বক্তব্যের শিরোনাম ছিল Asia’s Flashpoint, 1971: Bangla Desh। সেখানে তিনি এই সমস্যার যে সুত্রপাত, অর্থাত ভারতভাগ এবং পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের যে বঞ্চনা ও শোষন, সেগুলোর উল্লেখ করে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করেন, এবং সেসময় ভারতে অবস্থানকারী কয়েক মিলিয়ন বাংলাদেশি উদ্বাস্তুর আশু-পূনর্বাসনের প্রয়োজনীয়তার উপরে সবার দৃষ্টি আকর্ষন করেন। হার্ব ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল নিয়েও আলোচনা করেন, এবং কেন এই যুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের জন্য ন্যায়-যুদ্ধ আর পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য অন্যায়-যুদ্ধ, তা ব্যাখ্যা করেন। ইয়েমা প্রুডে কর্তৃক লিখিত হার্ব ফিথের জীবনী, ফ্রম ভিয়েনা টু জাকার্তা থেকে উদ্ধৃত করছি, যেখানে জীবনীকার বলছেনঃ

As Herb explained it, the situation in Bangladesh struck him in its initial weeks as uncannily like the crisis in Indonesia in 1965–66, involving a short-lived left-wing coup followed by an opportunistic crackdown on communist elements. Herb also recognised the strategic reasons for undertaking research of this kind. Pakistan and Bangladesh (formerly East Pakistan) had not been the subject of research by Australian political scientists. Yet the growing humanitarian crisis was in urgent need of international attention and understanding. His response, therefore, although scholarly, was also very much that of the activist (Purdey, 2011, p.339).

এই লেকচারটি পরে লিখিত আকারে সবার মাঝে বিতরণ করা হয়, যেখানে পূর্ব পাকিস্তান কেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চায়, সেই দাবীর যৌক্তিকতা ইতিহাসের আলোকে প্রমাণ করে দেওয়া হয়। কেন স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় জরুরী, তা তিনি খুব স্পষ্ট করেই যুক্তি দিয়ে তুলে ধরেন তার পাঠকদের সামনে। আমার বলতে দ্বিধা নেই, আমরা যদি আজকে এই ২০১৩ সালে হার্ব ফিথের মত একাগ্রতা, ঐকান্তিক ইচ্ছা ও প্রজ্ঞা নিয়ে কাজ করতে পারতাম, অস্ট্রেলিয়ায় তাহলে কোন রাজাকার কিম্বা তাদের বংশধর ও সমর্থকদের যেমন জায়গা হত না, তেমনি অস্ট্রেলিয়ার মানুষ ও সরকারের নিরংকুশ সহযোগীতা আমরা পেতাম যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রক্রিয়ায়।

তাঁর এই লেকচারটি সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পরিচালক জনাব মফিদুল হক বলেন, “আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সেই সময়ের সামগ্রিক অবস্থা ও তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত পুরোটাকে ধারণ করে – এমন পর্যালোচনা আমি খুব বেশী দেখি নি, বিশেষ করে বাংলাদেশ/পাকিস্তান/ভারতের বাইরের কারোর কাছ থেকে, যতটা হার্বের এই বক্তৃতায় পেয়েছি। তার প্রজ্ঞা, চিন্তার স্বচ্ছতা ও দুরদর্শীতা সত্যিই উল্লেখযোগ্য, যদিও তিনি পেশাগতভাবে দক্ষিন এশিয়ার ইতিহাসের স্কলার ছিলেন না। তিনি যখন পঁচিশে মার্চের কালোরাত্রির গণহত্যাকে ১৫৭২ সালের সেন্ট বার্থোলেমিউ এর গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেন, তখনি আমরা বুঝে যাই তার ইতিহাসসচেতনতার কথা, বাংলাদেশের সংকটময় পরিস্থিতির মূল্যায়নে তার নির্ভুল অবস্থানের কথা, যদিও ভূ-রাজনৈতিক কারণে মিডিয়ার কিছু অংশে পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতাকে খাটো করে দেখা হচ্ছিল সে সময়”।

হার্ব ফিথ ১৯৭২ সালের শুরুর দিকে স্বাধীন বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। পরে আরেকবার তার যাওয়া হয়েছিল রিসার্চের কাজে, যেখানে তিনি উদ্বাস্তুদেরকে নিয়ে কাজ করছে এমন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করেছেন। বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারীদের ব্যাপারেও তার সহানুভুতি ছিল – তিনি তাদের ক্যাম্পগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেছেন, তাদের বসবাসের অস্বাস্থ্যকর ও নিরাপত্তাহীন পরিবেশ ও অপর্যাপ্ত খাবার পানি, স্যানিটেশান ও পয়োনিষ্কাশন নিয়ে নানাজনের সাথে কথা বলেছেন, এবং ফার ইস্টার্ন ইকনোমিক রিভিউতে ‘বিহারো সরো’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ১৩ই মে ১৯৭২ সালে।
———-

মুক্তিযুদ্ধের সময় বহির্বিশ্বের মিডিয়াতে কোথাও কোথাও একে পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ, কোথাও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আবার কোথাও কোথাও এই যুদ্ধকে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনও বলা হচ্ছিল। একমাত্র যারা দক্ষিন এশিয়ার ইতিহাস সম্পর্কে ভালভাবে ওয়াকিফহাল ছিল, কেবল তারাই এই যুদ্ধের যৌক্তিকতা বুঝতে পেরেছিল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার আকাঙ্খার প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছিল। সেটা ছিল রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিবেচনার ব্যাপার। তবে সারা দুনিয়ার সবখানেই সাধারণ মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছিল পাকিস্তানীদের নৃশংসতা এবং উদ্বাস্তুদের মানবেতর জীবনযাপন। উদ্বাস্তুদের জন্য ত্রাণ সাহায্য সংগ্রহ, বিতরণ ও উদ্বাস্তুদের পূনর্বাসনে কাজ করেছেন অনেক মানুষ, যাদের অনেকের কথা আমরা জানি, অনেকের কথা আমরা ভুলে গেছি। এই অস্ট্রেলিয়ায় বসে সেসময় বেশ কিছু সহৃদয় মানুষ ভারতের শরনার্থী শিবিরে থাকা কয়েক মিলিয়ন মানুষের জন্য কাজ করেছেন নানাভাবে। মেলবোর্ন থেকে ক্যানবেরাস্থ অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্ট – এই সাড়ে ছয়শ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছিলেন একদল একটিভিস্ট, অস্ট্রেলিয়ান সরকারকে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশী শরনার্থীদের জন্য বেশি বেশি সাহায্য প্রদানে চাপ সৃষ্টি করার জন্য। বাইশ বছর বয়সী ডেভিড এলিস, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন টিউটর, এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন, এবং তার সঙ্গে আরো যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে শুধুমাত্র মাইক ক্রেমার এবং ফার্স্ট এইড অফিসার ডক্টর এলেক্স রস ছাড়া আর কারো নাম জানা যায় না। শুরু করেছিলেন যারা, সবাই শেষ করতে পারেননি অসুস্থতা, দূর্বলতা, সানস্ট্রোক ও পানিশুন্যতার কারণে। শেষ পর্যন্ত টিকে ছিলেন সাতজন। ১৯৭১ সালের নভেম্বরের ২০ তারিখে যাত্রা শুরু করে তারা ডিসেম্বরের সাত তারিখে ক্যানবেরায় পৌঁছান এবং সেখানে ফেডারেল পার্লামেন্টের সামনে এক প্রতিবাদসভার আয়োজন করেন। ডেভিড বলেন, অস্ট্রেলিয়ান সরকার বাংলাদেশের শরনার্থীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করছে। সরকারের উদ্দেশ্য শুধু এশিয়াতে সামরিকভাবে জড়িত থাকা, কিন্তু মানবিক বিপর্যয়ের মুখে তাদের যে কর্তব্য, তা তারা ভুলে গেছে। সেখানে দুজন মেম্বার অফ হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভও বক্তব্য দেন।
———-

মানসিকভাবে ভেঙে পড়া, অভুক্ত, দুর্বল ও অসুস্থ শরনার্থীদের জন্য অস্ট্রেলিয়ার Knoll Laboratories পাঠিয়েছিল পাঁচ মিলিয়ন মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট। সিডনী মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকার ১৬ই জুন, ১৯৭১ সালের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, তারা ভারতীয় রেড ক্রসের মাধ্যমে এই ট্যাবলেট বিতরণের জন্য বিমানযোগে কলকাতায় পাঠায়। কোম্পানীর কর্মচারীরা এক ছুটির দিনে আর্নক্লিফে তাদের কোম্পানীর ওয়্যারহাউজে উতসবমুখর পরিবেশে তাদের বাংলাদেশী বন্ধুদের জন্য এই শিপমেন্ট প্রস্তুত করে। ক্যানবেরার Pettit & Sevitt নামক একটি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি উদ্বাস্তুদের জন্য অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে আবেদন করেছিল তাঁবু, ট্রাপলিন, স্লিপিং ব্যাগ, কম্বল, গরম কাপড় ও খাবার-দাবারের। এংলিক্যান চার্চের সহযোগীতায় তারা বেশ কিছু নগদ অর্থ এবং অন্যান্য সাহায্য পায়, এবং সেগুলি AustCare এর মাধ্যমে ভারতে পাঠায়। Gollin & Company পাঠায় প্রায় ছয়হাজার ডলার মুল্যমানের তিন মাইল লম্বা পলিফেব্রিক, যা শরনার্থীদের জন্য অস্থায়ী আবাস বানাতে কাজে লেগেছিল। AustCare প্রায় দুই লাখ ডলার নগদ অর্থসাহায্য পেয়েছিল তাদের ফান্ড-রেইজিং অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। ২৬শে জুন ১৯৭১ তারিখে সিডনীর তরুন সঙ্গীতশিল্পী জেনি হ্যারিস AustCare এর আবেদনে সাড়া দিয়ে হার্স্টভিলে আয়োজন করেন একটি চ্যারিটি কনসার্ট। সেই অনুষ্ঠানে আরো গান করেন সিলভিয়া রে, দি পিটার লেইন অর্কেস্ট্রা, ইয়ং ওয়ার্ল্ড সিঙ্গারস নামে একটি গ্রুপ, ডায়ান হিটন ব্যালে, এবং কিথ হ্যারিস। যুদ্ধের শেষের দিকে, নভেম্বরের মাঝামাঝিতে, জনপ্রিয় পপ গায়ক বিলি থর্প পরিকল্পনা করেছিলেন এক টেলিথনের, যা কিনা প্রচারিত হবে ১৯৭১ সালের ক্রিসমাসের দিনে। এখানে একটু ব্যাখ্যা করি, টেলিথন হল টেলিভিশন ও ম্যারাথন শব্দদুটির সহযোগে বানানো একটি শব্দ, যার অর্থ হল এমন কোন চ্যারিটি বা তহবিল সংগ্রহ অনুষ্ঠান, যা টেলিভিশনে দীর্ঘ সময় ধরে প্রচারিত হয় – কয়েক ঘন্টা, দিন বা সপ্তাহ ধরেও হতে পারে। বিলির পরিকল্পনা প্রশংসা কুড়িয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির সব মহলের, এবং বিশটিরও বেশি মিউজিক গ্রুপ তাদের অংশগ্রহনের ইচ্ছা জানিয়েছিল এই আয়োজনে। বিলি থর্পের আরো ইচ্ছা ছিল অংশগ্রহণকারী সব শিল্পীকে নিয়ে একটা সিঙ্গেল ট্র্যাক করার, যেটির রয়ালটি থেকে প্রাপ্ত সব অর্থ বাংলাদেশের শরনার্থীদের জন্য দান করা হবে। দুঃখের বিষয়, এই টেলিথনটি আদৌ আয়োজিত হয়েছিল কি-না সে ব্যাপারে পত্র-পত্রিকায় কিছু জানা যায় নি। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে যুদ্ধ শেষ হয়, এবং সেক্ষেত্রে এই আয়োজনের ব্যাপারে অংশগ্রহণকারী কিছু গ্রুপের উতসাহে ভাটাও পড়ে থাকতে পারে। তবে প্রীতম দাসের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ব্লগের বরাতে জানাই, বিলি থর্প ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহেও এই আয়োজনের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন, কারণ তখনো শরনার্থীদের অর্থসাহায্যের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় নি।
———-

পাকিস্তান বর্ডার চ্যালেঞ্জঃ উই রিকগনাইজ বাংলাদেশ

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি তিনজন অস্ট্রেলীয় নাগরিক দিল্লীতে গিয়েছিলেন একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অংশগ্রহণের জন্য। জন ডানহাম, স্যালি রে ও জনসন। হঠাত করেই তারা পরিকল্পনা করলেন, ভারত-পূর্ব পাকিস্তানের পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত তারা পার হবেন হাতে “উই রিকগনাইজ বাংলাদেশ” লেখা ব্যানার নিয়ে। উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, বাংলাদেশের প্রতি সহমর্মিতা জানানো এবং মানুষ ও মিডীয়ার দৃষ্টি আকর্ষন। তাদের এই উদ্যোগ বেশ সাড়া ফেলেছিল, এবং এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘পাকিস্তান বর্ডার চ্যালেঞ্জ’। কুটনৈতিক কারণে ভারত সরকার অবশ্য তাদেরকে নিরস্ত করেন, এবং সেকারণে তাদের এই পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখেনি। তবে তারা থেমে থাকেননি, নিজেদের সাধ্যমত চেষ্টা করে গেছেন বাংলাদেশের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষন করতে। জন ডানহাম তার লেখায় ও বক্তব্যে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়ে তার জোরালো মত তুলে ধরেন এবং তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি দাবী করেন। দি এজ পত্রিকার ২২ ও ২৩শে সেপ্টেম্বরের দুটো রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এই তিনজন সবমিলিয়ে সাত দেশের বারোজনকে নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে চেয়েছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিপত্র হাতে নিয়ে। নাটকীয় ব্যাপারস্যাপার। তারা এই প্রতিকী সীমান্ত-অতিক্রমকে গান্ধীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের জন্য স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা বলে বলে জানান। এর আগে লন্ডনভিত্তিক ওমেগা রিলিফ টিম পাকিস্তান সরকারের অনুমতিছাড়াই বাংলাদেশে ঢোকায় পাকিস্তান সরকার তাদেরকে বহিষ্কার করেন। তাদের আরো একটি দলকে গ্রেফতার করা হয়। সেখানে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিপত্র হাতে নিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার এই চেষ্টা শুধু প্রতিকী অর্থেই নয়, ব্যবহারিক অর্থেও বাংলাদেশের স্বীকৃতির পক্ষে এক বড় ধাপ।
———-

একেবারে সম্প্রতি, যখন বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি হালে পানি পায় নি, অস্ট্রেলিয়ার গ্রীন পার্টীর ম্যাগাজিনে একাত্তুরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, Justice sought for 1971 victims শিরোনামে। ২০০৭ সালের এই রিপোর্টে বলা হচ্ছে, পঁচিশে মার্চের গণহত্যা গত শতকের সবচেয়ে ভয়ংকর পাঁচটি গণহত্যার একটি (গিনেস বুক অফ রেকর্ডস, ২০০৭)।নিরস্ত্র ও নিরীহ শান্তিকামী বাঙালীদের উপরে খুন ও ধর্ষন চালানো পাকিস্তানী বাহিনীর অত্যাচারে অন্তত তিরিশ লাখ লোক শহীদ হয়। ১৯৪৭ সালে ভারতভাগের ফলে যে পাকিস্তানের জন্ম হয়, তা হিন্দুত্ববাদীদের বিপরীতে একটি আদর্শিক বা ধর্মীয় অবস্থান হিশেবে যথেষ্ঠ আকর্ষনীয় হলেও, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ভাল-মন্দ বিবেচনায় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের কাছে তা ছিল এক উটকো ঝামেলা মাত্র। পূর্ব পাকিস্তান আবারো উপনিবেশে পরিণত হয়, তবে এবারে তাদের দেশেরই আরেক অংশের কাছে। এর উপরে আবার চেপে বসে ১৯৫৮ সাল থেকে সামরিক শাসন, যা বাংলাদেশের মানুষ চায় নি। ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে টানাপোড়েন তো ছিলই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের বাই-পোলার ফলাফল এবং শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি পাকিস্তানের ভাঙন ত্বরান্বিত করে। তবে আপোষে হয় নি সেই ভাঙন – নিরস্ত্র মানুষের উপরে সামরিক হামলার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল, শেষ হয়েছে ৯০ হাজার সৈন্যসহ দাম্ভিক এক জেনারেলের আত্নসমর্পণের মধ্য দিয়ে। ডক্টর আবুল হাসনাত মিল্টনের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক ‘Justice for Bangladesh Genocide 1971 inc’ কাজ করছে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করার ব্যাপারে সরকার ও বহির্বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য। ডক্টর মিল্টনের বেশ কিছু বক্তব্য প্রকাশ করা হয় সেই প্রতিবেদনে।
———-

ভাবতে অবাক লাগে, খোদ বাংলাদেশে সেই মাটিরই কিছু সন্তান যখন নিজের দেশের বিরূদ্ধে, নিজের দেশবাসীর বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্রে ও যুদ্ধে লিপ্ত, তখন ভারত মহাসাগরর অপর পাড়ে মেলবোর্নে কিছু সুহৃদ আমাদের দেশের জন্য যে সহমর্মিতা ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তা অভাবনীয়। তাদের এই উদ্যোগ আমাদেরকে আপ্লুত করে, এবং একইসাথে আমাদেরকে ঋণীও করে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এই ব্যাপারটা বরাবরই আমাকে ভাবায় – তাদের অনেকেই বাংলাদেশ দেখেন নি, বাংলাদেশে তাদের কোন স্বার্থ নেই, অথচ স্বাধীনতাকামী এবং মজলুম এই জনগোষ্ঠীর শুভকামনায় বিশ্বের নানা দেশের নানা শহরের মানুষ সেসময় একাট্টা হয়েছিলেন, জনমত গড়ে তুলেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে, বাংলাদেশের গণহত্যাকে মিডীয়াতে এবং আর্টের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন, কয়েক মিলিয়ন ঘরছাড়া উদ্বাস্তুর জন্য ত্রাণসামগ্রী জোগাড় করেছিলেন। শেষ বিচারে এ আসলে মানবিকতার জয়, মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসার জয়, হিংস্রতা, মিথ্যা ও কপটতার বিরুদ্ধে সত্য ও সুন্দরের জয়। বাংলাদেশের সেই সব নাম জানা-না জানা বন্ধুদের সবাইকে হয়তো বাংলাদেশ সন্মানিত করতে পারে নি, কিন্তু বাংলাদেশ তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
———-

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, তাহমিমা আনামের এ গোল্ডেন এইজ, অনলাইনে প্রিতম দাস নামক একজন গবেষকের ব্লগ, মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের হার্ব ফিথ ফাউন্ডেশানের ওয়েবসাইট, হার্ব ফিথের জীবনী ফ্রম ভিয়েনা টু জাকার্তা, ভিক্টোরিয়ান কমিটি টু সাপোর্ট বাংলাদেশ পেপারস, ১৯৭১ এবং ১৯৭১ সালের বেশ কিছু অস্ট্রেলিয়ান নিউজপেপারের রিপোর্ট।

গ্রন্থনায় : আশরাফুল আলম এবং সানিয়াত ইসলাম



Place your ads here!

Related Articles

না ঘুমানোর দল

বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাথে চানখার পুল আর স্টার হোটেলের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাতজেগে পড়াশুনার পর সস্তায়

কয়েকবার বলুন, ডাহা মিথ্যেও সত্য হবে!

হঠাত করেই না-কি পরিকল্পনানুযায়ী কি-না জানি না, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি কে এই নিয়ে আমাদের দুই নেত্রীর মাঝে চলছে বিতর্ক

A appeal from younger generation to protect Environment for future

Dear Dad, Mum, Grand Parents Good morning!!!!!!!! I would like to take the opportunity to urge you and others who

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment