স্বদেশে “শহীদ মিনার” – প্রবাসে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” কেন

স্বদেশে “শহীদ মিনার” – প্রবাসে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” কেন

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেরুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি” এই গানের আবেগ জড়িত সূর আর ‘শহীদ মিনার’ যেন বাংলাভাষা আন্দোলন নামক স্রোতস্বিনী নদীর কলকলানো সূরে গড়িয়ে যাওয়া জল প্রবাহ! বায়ান্নের মহান ‘একুশ’ যার শৃঙ্গ; আবহ বঙ্গসংস্কৃতি-কৃষ্টি তার চারণ ভূমি! যার উর্বরতার ফসলঃ মুক্ত স্বদেশ, স্বাধীনতা, সার্বভৌম একটি দেশ- ‘বাংলাদেশ’! বৈশ্বিক চেতনাদীপ্ততায় প্রজ্বলিত ফলনঃ একুশ আজ “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস”, বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ সকল মাতৃভাষাভাষীর অনুপ্রেরণা- যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আকাশচুম্বী অগ্রগতি, ডিজিটালাইজডমুখি বিশ্ব এবং বিশ্বায়নের উত্তাল হাওয়ায় ছিন্ন-ভিন্ন আদি সভ্যতার ভিত্তি ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা ব্যবস্থার সনাতন ধারা। বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের বেসামাল ঝুঁকিতে অনেক মাতৃভাষা হয়েছে বিলীন, কতিপয় বহুপ্রচলিত ভাষা ছাড়া বাকি অধিকাংশ মাতৃভাষাই বর্তমানে একই ভাগ্যের মুখোমুখী! মাতৃভাষা সমূহের অবক্ষয়ে অব্যাহত এই ধারা বিশ্ব সভ্যতা-সংস্কৃতি সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ হুমকি হিসেবে আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে বিশেষ চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ‘একুশের চেতনা’ আজ বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ সকল মাতৃভাষা সুরক্ষা বা অসহায়ত্ব থেকে পরিত্রানের নিয়ামক শক্তি-সাহস হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দণ্ডায়মান।

একুশে ফেব্রুয়ারি’র “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” মর্যাদায় উত্তরণ, বিশ্বব্যাপ্ত মাতৃভাষা অবক্ষয়ের প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা নিরাময়ের প্রয়োজনে নির্বাচিত, এবং অনুকরণের উৎকৃষ্টতা-উপযোগ্যতায় বিবেচিত। একুশে ফেব্রুয়ারিকে এই ‘দিবস’ হিসেবে নির্বাচন ত্বরান্বিত করেছে বিশ্বময় মাতৃভাষা অবক্ষয়ের বাস্তবতা প্রতিরোধে ইউনেস্কোর দীর্ঘসুরী গবেষণার আলোকে গৃহীত পূর্বসিদ্ধান্তের নীতিগত অবস্থানের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ‘দিবস’ হিসেবে একটি ‘দিবস’ চিহ্নিত করনের প্রয়োজনীয়তার কথা জাতিসংঘ বরাবরে ব্যাক্তিবিশেষের লিখিত আবেদনের ফলে। আবেদনপত্রে ‘দিবস’ হিসেবে মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বিশেষ ভাবে উপস্থাপিত হয়। একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ের অনুভূতি এবং উদ্যোগ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক, এবং পরবর্তীতে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের প্রথামাফিক আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের প্রেক্ষিতেই মহান একুশের এই বৈশ্বিক উত্তরণ। কানাডা অভিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত রফিকুল ইসলামের একান্ত ব্যাক্তি পর্যায়ের নীবিরতম দেশপ্রেম, সকল মাতৃভাষা সুরক্ষার প্রতি বাস্তবানুগ মুল্যবোধ ও শ্রদ্ধা, অভিবাসী জীবনব্যবস্থার অভিজ্ঞতা্র সাথে বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষার সমূহের অবক্ষয়রোধের বৈশ্বিক তাগিদের প্রয়োজনের সমন্বয়ভিত্তিক সুদূরদর্শী বিচক্ষন প্রস্তাবই একুশের এই বৈশ্বিক উত্তরণের পথ সুগম করেছে। মহান একুশের এই বৈশ্বিক সম্মানন অবস্থানে উত্তরণে একদিকে যেমন অবক্ষয়ে জর্জরিত মাতৃভাষা সংরক্ষনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টা বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে, অন্যদিকে তা প্রতিরোধে দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী তথা অনুপ্রেরণামূলক উপাদান হিসেবে মহান একুশের ইতিহাস ও মূল্যবোধকে কৌশলে উত্থাপন করা হয়েছে। বাংলার আবেগ-সংগ্রাম-ত্যাগ তিতিক্ষার ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্তের সাথে বৈশ্বিক প্রয়োজনের যৌক্তিক সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। যার ফলে ইউনেস্কো কর্তৃক বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আবেদনকারীর ভাব-আবেগের সাথে অভিবাসী জীবনের স্বাচ্ছন্দতা অথবা অনুশোচনার চেয়েও বৈশ্বিক প্রয়োজনের তাগিদে মহান একুশ’কে এই বিষয়ে সর্বোৎকৃষ্ট ‘দিবস’, এবং একুশে’র চেতনা’কে সকল ভাষাভাষীর জন্য যুতসই অনুকরণীয় চেতনা হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। একান্ত ব্যাক্তি পর্যায়ের বিশ্বব্যাপ্ত সকলের জন্য উপযোগ্য চেতনাদীপ্ত প্রস্তাব এবং প্রচেষ্টা হয়েছে আজ বিশ্বের সকল ভাষাভাষীর জন্য অনুকরণীয়।

একজন ব্যাক্তির চেতনা থেকে প্রতিষ্ঠানে, প্রতিষ্ঠান থেকে রাষ্ট্রে, রাষ্ট্রের সুদক্ষ কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় জাতিসংঘের প্রথাগত আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে একুশের আন্তর্জাতিক দিবসে উত্তরণ যত সহজে অর্জিত হয়েছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, বাস্তবে তা নয়। বিষয়টি স্বাভাবিক নিয়মে অর্জন করা অতি কষ্টসাধ্য এবং দীর্ঘ সময়ের কূটনৈতিক প্রতিযোগিতার টানাপোড়নেই সম্ভব। এই ক্ষেত্রে মাতৃভাষা চর্চায় সৃষ্ট রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা থেকে উত্তরণে একুশের চেতনা, ত্যাগ, দৃঢ় প্রতিশ্রুতি এবং সামগ্রিক অর্জনকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষা অবক্ষয়ের বৈশ্বিক সংকট নিরসনে সকল ভাষাভাষীর কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে উপযোগ্য এবং সম্মানিত ভাবে দেখা হয়েছে। মাতৃভাষা অবক্ষয়ে বৈশ্বিক সংকট নিরসনের বাস্তবতা ব্যাতিরেকে একুশের এই বৈশ্বিক উত্তরণ তথা আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন ছিল অসম্ভব। সেকারণে আন্তর্জাতিক বলয়ে অবক্ষয়মান মাতৃভাষাসমূহ সংরক্ষণে একুশের চেতনার প্রখরতা বহুজাতিক সমাজ ব্যবস্থায় সকল ভাষাভাষীর কাছে যতই কার্যকরী, ব্যাপ্ত এবং দিপ্তময় হবে, বিশ্বময় বাংলা এবং বাঙালি একুশের সম্মানে ততই প্রজ্বলিত হয়ে মুখরিত হবে, সম্মানিত হবে। মাতৃভাষা সমূহের ভয়াবহ অবক্ষয়ের কারনে এই বাস্তবতা শুধুই সময়ের অপেক্ষা মাত্র। সেজন্য সবচেয়ে প্রয়োজন প্রবাসে বাঙালি চেতনাভিত্তিক মহান একুশকে শুধুই নিজেদের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না রেখে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” চেতনাভিত্তিক একুশের আঙ্গিকে উত্তরণে আমাদের(বাঙালিদের)সার্বিক ও সমন্বিত প্রচেষ্টা, এবং সামগ্রিকভাবে উদারতায় সকল ভাষাভাষীকে নিয়ে সমন্বয় সাধন। প্রয়োজন বাংলাভাষা(আমাদের মাতৃভাষা)আন্দোলনের জাতীয় স্পিরিটকে- বৈশ্বিক ঝুঁকিপূর্ণ সকল মাতৃভাষা সংরক্ষনের প্রয়োজনে উৎসাহব্যাঞ্জক বৈশ্বিক স্পিরিটে উত্তরণ; এবং আমাদের বাংলা (মাতৃ)ভাষা আন্দোলনের প্রতীকী স্থাপত্য “শহীদ মিনার” এর আদলে বৈশ্বিক সকল মাতৃভাষা সংরক্ষণে কৌশলী স্থাপত্য, “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সকল ভাষাভাষীর অংশগ্রহণ তথা সমাবেগ জড়িত অংশীদারিত্ব নিশ্চিতকরনের সুযোগ সৃষ্টি। বিশ্বায়নের যুগে আমাদেরকে আমাদের মহান একুশের এই ঈর্ষনীয় বৈশ্বিক অবস্থানকে যতবেশী সংকীর্ণতা মুক্ত করে বহুভাষাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার উপযোগী হিসেবে উন্মুক্ত ও সম্মানিত করে তোলা যাবে, তত দ্রুত আমাদের নতুন প্রজন্ম আমাদের মাতৃভাষা-সংস্কৃতি তথা জাতীয় গর্ব এবং ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠবে এবং গর্বিত চিত্তে মাতৃভাষা বাংলা শিখায়ও আগ্রহী হবে।

প্রবাসে বহুভাষাভিত্তিক সমাজের অভিবাসী হিসেবে সকল ভাষাভাষীরাই মূল ধারায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি নিজ নিজ ভাষা-সংস্কৃতি সংরক্ষনে কম-বেশী সংবেদনশীল; এবং আন্তঃসমাজস্থিত মানসিক চাপে ক্লান্তিহীন প্রতিযোগী। অধিকিন্তু কর্তৃপক্ষ বা সরকারের পক্ষ থেকে সকল জাতি-গুষ্টির জন্য সংস্কৃতি-কৃষ্টি চর্চা বা লালন-পালনে তাৎক্ষনিক সুযোগ সুবিধা প্রদান অথবা সমতা রক্ষা সকল ক্ষেত্রে সম্ভবও নয়। ফলে কোন বিশেষ গুষ্টির একক ঐতিহ্যমণ্ডিত বিশেষ কোন উদ্যোগে সার্বজনীনতা অর্জনতো দুরের কথা, বরং গ্রহণযোগ্যতা অর্জন যথেষ্ট কষ্ট এবং সময় সাপেক্ষ। বাস্তব এই অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়েছে পৃথিবীর প্রথম ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ’ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, যা প্রাথমিকভাবে ২০০১ থেকে শুরু হয়েছিল অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ থেকে। যার ফলশ্রুতিতে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ’ এর প্রণীত নকশা ও স্থাপত্যকলায় সকল ভাষাভাষী অর্থাৎ সকলের জন্য উন্মুক্ত এবং সমাধিকার ভিত্তিক মাতৃভাষা চর্চা বা সংরক্ষণের ব্যবস্থাগ্রহন সহজতর করে সকল ভাষাভাষীর কাছেই নিজ নিজ মাতৃভাষাসহ সংস্কৃতি সংরক্ষণে আগ্রহী করে তুলতে সাহায্য করছে। বিশেষ করে ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্তের আলোকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ’ এর দর্শন বিশ্বব্যাপী সকল ভাষাভাষীর সমন্বিত প্রয়াসের প্রায়োগিক ক্ষেত্র সৃষ্টির জন্য পরিপূরক।

আধুনিক সভ্যসমাজের সকলেরই মাতৃভাষা রয়েছে, সকলের ক্ষেত্রেই অভিন্ন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তার সংস্কৃতি-কৃষ্টি গড়ে উঠেছে নিজ নিজ মাতৃভাষার আঙ্গিকে। যার অধিকাংশই আধুনিক বিশ্বের বিশ্বায়ন এবং ডিজিটাইলেজশন ফলশ্রুতিতে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মুখোমুখি। এই অনিবার্য পরিস্থিতি প্রতিরোধে ইউনেস্কোর কৌশলী সিদ্ধান্ত প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” উদযাপন। এই বৈশ্বিক সিদ্ধান্তকে সকল ভাষাভাষীর মধ্যে গণসম্পৃক্ত করে তুলতে হলে বিশ্বায়নের ধারায় প্রতিটি ভাষাভাষীর অবাধ এবং আন্তরিক সম্পৃক্ততা নিশ্চয়তা বিধান ছাড়া অন্যকোন বিকল্প নেই। বাংলার মহান একুশকে বাংলার বলয় থেকে বের করে সকল ভাষাভাষীর উপযোগ্য বৈশ্বিক সোপানের একুশের আঙিনায় উত্তীর্ণ করার প্রাথমিক দায়িত্ব বাঙালিদের। একইভাবে মহান একুশের বাহক বাংলার শহীদ মিনারের স্থিতস্থাপত্য যাতে বিশ্বের সকল ঝুঁকিপূর্ণ ভাষা সংরক্ষনের প্রয়োজনের প্রতিকৃত হিসেবে সঞ্চারিত হয়, এমনভাবে বৈশ্বিক একুশের প্রয়োজনীয় ভাবধারার প্রতীকী স্থাপত্যে উত্তরণ অবস্যাম্ভাবি। পৃথিবীর প্রথম ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ’ এর স্থাপত্যে অত্যন্ত যত্ন ও সন্মানের সাথে বিশ্বায়ন, বহুজাতিক আধুনিক সমাজব্যবস্থা এবং অন্যান্য স্থানীয় মাতৃভাষাসহ বৈশ্বিক মাতৃভাষা সংরক্ষনের আবেদন, “কনসারভ ইউর মাদার ল্যাংগুয়েজ” সহ শহীদ মিনার এবং একুশের তথ্যাদি উপস্থাপিত হয়েছে। সম্ভাব্য সকল ভাষাভাষীর সাথে পরামর্শক্রমে সকলের উপযোগী করে সহজতরভাবে সমন্বিত এই স্থাপত্যকলা অন্য ভাষাভাষীদের কাছে আবাধে নিঃসংকোচে পক্ষপাতহীনভাবে অংশীদারিত্বের উপলব্দির সঞ্চারণ করেছে, এবং বাংলার মহান শহীদ মিনারের আদলেই নিজ নিজ মাতৃভাষা সংরক্ষণে অনুপ্রাণিত হয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় বাংলার একুশ এবং শহীদ মিনারের সুপ্ত চেতনায় সকলের নিজ নিজ মাতৃভাষা রক্ষায় সিক্ত হয়ে উঠছে। ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ নামের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখা, এই দিবস উদযাপনের সংগতিপূর্ণ অর্থবহ প্রকাশনা এবং দিবস হিসেবে একুশের স্পিরিটকে বিকশিত করার বিবেচনায় শহীদ মিনারের আন্তর্জাতিক সংস্করণ হিসেবে, “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” বিশেষভাবে অর্থবহ এবং যৌক্তিক। বিশেষ করে ‘দিবস এবং স্মৃতি’ শব্দদ্বয়ের উপস্থিতি পর্যায়ক্রমে আমাদের মাহান একুশ, একুশের ভিত্তি, একুশের ইতিহাস, শহীদ মিনার এবং একুশের চেতনার গর্বিত ঐতিহ্য সংক্রান্ত সামগ্রিক বিষয়াদিকে সুকৌশলে সকল ভাষাভাষীর কাছে স্থান করে নিতে সাহায্য করবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একুশ, শহীদ মিনার এবং বাংলাকে খুঁজে পাবে ‘দিবস এবং স্মৃতি’র মধ্য দিয়ে, যা কোন অবস্থায় শুধুই ‘শহীদ মিনার’ নামাকরনের মাধ্যমে অর্জন সম্ভবপর নয়। আমাদের ‘শহীদ মিনার’ রাজনৈতিক অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আত্মহুতির গর্বিত প্রতীক, যা বৈশ্বিক ভাষা অবক্ষয়ের অন্যান্য বহুবিধ কারনের সাথে একাকার করে ফেলা আমাদের শহীদ মিনারের গভীর আবেগকে অন্যান্য ভাষাভাষীদের কাছে একদিকে হালকা করা, অন্যদিকে ভাষা অবক্ষয়ের অন্যান্য বাস্তব কারনগুলোকে পাশকাটিয়ে যাওয়া হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রবাসে ‘শহীদ মিনার’ প্রতিষ্ঠা শুধুই আমাদের আবেগ অনুভুতির প্রতিফলনে যথার্থ বটে, তবে তা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশের অধিষ্ঠানের পূর্ববর্তী সময়ের জন্য প্রযোজ্য ছিল, পরবর্তী সময়ের জন্য নয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশের অধিষ্ঠানের পরবর্তী সময়ে প্রবাসে ‘শহীদ মিনার’ এর প্রতিষ্ঠা একুশের আন্তর্জাতিক সম্মানকে অবমূল্যায়ন করার মত অভিযোগকে অবজ্ঞা করা যাবে না, কারন বাংলাভাষা আন্দোলন ভিত্তিক শহীদ মিনারের ঐতিহাসিক বা দার্শনিক ভিত্তি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদযাপনের বৈশ্বিক বহুমাত্রিক প্রেক্ষাপট বা দর্শনের সাথে গুলিয়ে ফেলার সুযোগ নেই, বরং নৈতিক কারনে রয়েছে এর সাথে আমাদের মৌলিক যোগসূত্র সৃষ্টি এবং তা রক্ষার নিশ্চিতকরণের বাধ্যবাধকতা। অন্যথায় ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষাগুলির মতই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমাদের ঐতিহ্য ও গর্বের বৈশ্বিক ‘একুশ’ও ভেসে বিলীন হয়ে যাবে বিশ্বায়নের প্রবল স্রোতে।

বাংলার ‘শহীদ মিনার’ এর আদলে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় বা প্রধান প্রধান শহরে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” এর স্থাপত্যের অবস্থান এবং প্রতিটি লাইব্রেরীতে “একুশে কর্নার” এর প্রবর্তন একদিকে যেমন সকল ভাষাভাষীর কাছে আমাদের গ্রহনযোগ্যতা এনে দেবে, অন্যদিকে সময়ের তালে তালে বাংলা, বাঙালি, একুশ এবং বাংলার শহীদ মিনার সকল ভাষাভাষীর কাছেই ভিন্নমাত্রায় মুল্যায়ন পাবে, হবে সম্মানিত। আমাদের প্রত্যেকের অভিবাসী জীবনব্যবস্থায় নিজ দেশীয় কলা কানুন ছেড়ে নূতন পরিস্থিতি পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার অনিবার্যতার মত একই মানসিকতায় আমাদেরকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” এর বৈশ্বিক প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি বিশ্ববাস্তবতার নিরিখে বিবেচনা করেই দেশ, সমাজ, সংস্কৃতির সার্বজনীনতার ভিন্নতার প্রেক্ষাপটের সাথে সমন্বয়তা রক্ষা করে শুধুই আমাদের ‘শহীদ মিনার’ নয়, বরং সকল ভাষাভাষীর উপযোগী করেই “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” প্রতিষ্ঠা করাই হবে বাঞ্ছনীয় এবং বাস্তবানুগ সিদ্ধান্ত, যা হবে বিশ্বায়নের ধারার সাথে সংগতিপূর্ণ।

একক যেকোন গুষ্টির ঐতিহ্যের প্রতিফলনে বহুজাতিক সমাজে নির্মিত যেকোন স্থাপত্য বহুজাতিক সমাজে স্থায়ীত্ব পাওয়া সম্ভবপর নয়, এবং অন্যান্য সকল ভাষাভাষীদের আকৃষ্ট করতে যে ব্যর্থ হবে তা আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। যেকোন ব্যাক্তির জাতীয়, ধর্মীয়, সামাজিক, পারিবারিক অনুষ্ঠান উপযোগী পোশাকে নিজেকে উপযোগ্য করে তোলার মতই আমাদেরকে স্বদেশী ধ্যান-ধারনাপুষ্ট শহীদ মিনারের আবেগ থেকে বের হয়ে প্রবাসের পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী বিশ্বায়নের বিস্তৃত পরিবেশে একুশে‘র আন্তর্জাতিক সম্মানের বিষয়টি প্রাধান্য দিতে হবে। স্বদেশে আইকনিক জাতীয় নকশা ছাড়াও বিভিন্ন নকশা-স্থাপত্যে শহীদ মিনার থাকলেও কোথাও চেতনা বা মূল্যায়নে ঘাটতি নেই, সর্বত্র শহীদ মিনার। তেমনি প্রবাসের শহীদ মিনার বিভিন্ন ভৌগলিক অবস্থানে বিভিন্ন ভাষার অবক্ষয় বা বিভিন্ন ভাষাভাষীর আবাস এবং ভাষার অবস্থার উপ্র ভিত্তি করে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” এর নামে প্রতিষ্ঠা পাবে, (যেমনটি হয়েছে প্রথম নির্মিত ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ থেকে আইকনিক ‘শহীদ মিনার’-এ উত্তরণের ক্ষেত্রে)যার স্থাপত্যকলায় ভিন্নতা হলেও সেই স্থাপত্যে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” এর চারটি মৌলিক উপাদান নিশ্চিত করা হবে অপরিহার্য। যার মাধ্যমেই “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” এর নকশায় অন্তঃস্থিত বাংলার শহীদ মিনার ধীরে ধীরে স্থান করে নিবে বিশ্বের সকল ভাষাভাষীর অন্তরে, একইভাবে যেভাবে ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ থেকে জাতীয় প্রয়োজনে বিবর্তিত নামাকরন হয়েছে, “শহীদ মিনার”।

লেখক পরিচিতিঃ নির্মল পাল; ইমেইলঃ nirmalpaul@optusnet.com.au
প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারপারশনঃ এমএলসি মুভমেন্ট ইনটারন্যাশন্যাল ইনক
প্রাথমিক নকশা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নকারী দলনেতাঃ পৃথিবীর প্রথম “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ”
প্রকাশিত গ্রন্থঃ “বিশ্বায়নে শহীদ মিনার”
বৈশ্বিক দর্শনঃ “লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার”, (স্থানীয় বর্ণমালা সংরক্ষণ কেন্দ্র)

Nirmal Paul

Nirmal Paul

নির্মল পাল; ইমেইলঃ nirmalpaul@optusnet.com.au; প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারপারশনঃ এমএলসি মুভমেন্ট ইনটারন্যাশন্যাল ইনক; প্রাথমিক নকশা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নকারী দলনেতাঃ পৃথিবীর প্রথম “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ”; প্রকাশিত গ্রন্থঃ “বিশ্বায়নে শহীদ মিনার”; বৈশ্বিক দর্শনঃ “লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার”, (স্থানীয় বর্ণমালা সংরক্ষণ কেন্দ্র)


Place your ads here!

Related Articles

বহে যায় দিন – দিন চলে যায়, সবই বদলায়

> বহে-যায়-দিন সকল প্রকাশিত পর্ব > ।। এক ।। দিন চলে যায়, সবই বদলায় (২০০৬ প্রকাশিত ধারাবাহিকের পুনঃ প্রকাশ) সকাল

রুবি চলে গেলো অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে

ফজলুল বারী: অতঃপর চলে গেলো রুবি। এটি অবশ্য বাংলা গানের কবিতার সেই রুবি রায় নয়। রুবি প্রিন্সেস। সেই আলোচিত সমালোচিত

Bangladesh Prime Minister Sheikh Hasina arrives at Perth to attend the Commonwealth Summit

Bangladesh Prime Minister Sheikh Hasina will be attending the Summit of the Commonwealth heads of the Government (CHOGM). The heads

3 comments

Write a comment
  1. Dilruba Shahana
    Dilruba Shahana 6 February, 2018, 23:36

    আন্তর্জাতিক পরিসরে একুশে ফেব্রুয়ারীকে মাতৃভাষা দিবস ঘোষণাই ভাষা শহীদদের প্রতি সন্মাণনা প্রদর্শন। আজ শুধু শোকের নয় স^ স^মাতৃভাষাকে ভালবাসার বহমান প্রতীক ও তাৎপর্য হল শহীদ মিনার। আমাদের প্রায় সবার জানা শহীদ মিনার স্বারক সম্বলিত ডাকটিকিট আমেরিকান সরকার বের করেছিল বেশ ক’বছর আগেই।
    শহীদ মিনার মায়ের ভাষাকে ভালবাসার প্রতীক, এই ভালবাসার অধিকার সবার। সুতরাং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্তম্ভেও এই প্রতীকের স্থান থাকা জরুরী।
    গর্ব ও আবেগে চোখ ভিজে উঠলো গত অক্টোবরে যখন দেখলাম লন্ডনের টিউবে বাংলায় নির্দেশিকা লিখিত রয়েছে। এমন দিন আসছে বিশে^র যেখানেই হোক না কেন শহীদ মিনার চিহ্ন বা সিম্বল দেখলেই মানুষ বুঝবে এখানে বাংলাভাষী রয়েছে। সে হতে পারে লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার বা বহুভাষী বইয়ের দোকানে বাংলা বইয়ের সম্ভারের প্রতীক।

    Reply this comment
    • নির্মল পাল
      নির্মল পাল 10 March, 2018, 13:09

      জনাব দিলরুবা শাহানা আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আপনার কমেন্টের জন্য। হাঁ , “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধে” র চারটি মৌলিক উপাদানের মধ্যে একটি উপাদান একুশের চেতনা ভিত্তিক তথ্যাদি, যার কেন্দ্রে বা বক্ষে রয়েছে বাংলার শহীদ মিনার এর ছাপ, এবং ছাপের পরিচিতির জন্য নীচে শহীদ মিনার শব্দ দুটিও যুক্ত রয়েছে । পৃথিবীর প্রথম “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধে” র বুকে খোদাইকৃত শহীদ মিনার কে আমরা ২৩ কেরেট সোনা ভরাট করে এই বৈশ্বিক চেতনার প্রাণ হিসেবে ফুটিয়ে তূলতে সক্ষম হয়েছি।

      Reply this comment
  2. Dilruba Shahana
    Dilruba Shahana 19 March, 2018, 05:56

    Dhonnobad Nairmal Pal. Valolaglo jene.

    Reply this comment

Write a Comment